বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১১

বাংলাদেশেই এ মুহূর্তে ২১ লাখের বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। এত যে জনপ্রিয়তা, সে কারণেই ফেসবুক শুধু ব্যক্তিগত যোগাযোগের গণ্ডিতে আর আবদ্ধ নেই। সামাজিক, রাজনৈতিন আন্দোলন বা জনমত গড়ে তোলার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে অনলাইনের এই মাধ্যমটি। ফেসবুকের এমন ব্যবহারই সবার কাম্য।
আবার যে কথা খোলা ময়দানে বলা যাচ্ছে না, কিন্তু তা দেশ-সমাজ ও সংস্কৃতির সংস্কারে বা উন্নতিতে প্রয়োজন—সে বিষয়ে সহজেই ব্লগে একটি লেখা সম্ভব। চাইলেই নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করা সম্ভব। অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ, ব্লগ—এ বিষয়গুলো আমাদের দেশে নতুনই বলা যায়। তবে এসবের অপব্যবহারও ইদানীং দেখা যায়। সাম্প্রতিক কালে দেখা গেছে, একটি মেয়ের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে ছবি সরিয়ে ফেসবুকে ও ব্লগে প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর তাতে নানা ধরনের অরুচিকর মন্তব্য লেখা হয়েছে। কয়েকজন ব্লগার এর ওপর ভিত্তি করে এমন সব ব্লগ লিখেছে, যা রীতিমতো তাদের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ ঘটায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বললেন, ‘হঠাৎ একদিন দেখলাম, আমার ছবিতে অশ্লীল শব্দ ট্যাগ করা। লজ্জায় মাথা নুয়ে এল। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিলাম।’
নাদিয়া (ছদ্মনাম) বললেন, ‘অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও আমার ফেসবুকের ওয়ালে দেখা যায়। এসবের কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। ব্লগগুলোতে মাঝেমধ্যে এমন সব ভাষা ব্যবহার করা হয়, যা রুচির পরিচয় দেয় না। এসব দেখলে মনে হয় না ভালো কিছু লিখি। আর স্বভাবতই মানুষের এসব পড়ার প্রতি আকর্ষণ বেশি। নারীসংক্রান্ত কিছু হলে তো কথাই নেই, অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেন এসব মন্তব্য করলেই সমাজ শুদ্ধ হবে। এতে যে আরেকজনকে হেয় করা হচ্ছে, সেটি তারা ভাবে না। তাৎক্ষণিক একটা বিকৃত উল্লাসে তারা মেতে ওঠে। ভাবে, এই নারীকে হেয় করতে পারলেই সমাজের নারীকুলকে উদ্ধার করা সম্ভব।’
দেশের স্বনামধন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন সেরিন (ছদ্মনাম)। পাশাপাশি শখের মডেলিংও করেন। বললেন, ‘এক বন্ধুর কাছে ফটোসেশন করেছিলাম। ছবিগুলো তার ফেসবুকের অ্যালবামেই ছিল। সেখান থেকে কে বা কারা বেশ কয়েকটি পর্নোসাইটে আমার ছবি দিয়ে দেয়। এরপর কী হয়েছিল, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তারা। শখের মডেলিং বন্ধ হয়ে গেল। বাসা থেকে সবকিছুতে নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। মরে যেতে ইচ্ছে হলো আমার। এ কেমন সমাজে বাস করছি।
‘কিন্তু মেয়ে দেখলেই এমন করতে হবে কেন? এর কি সত্যিই কোনো সমাধান নেই?’
এ বিষয়ে রায়ানস আর্কাইভস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী আহমেদ হাসান বলেন, ‘ব্লগ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আমরা যা দেখি, তা আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি। অনেক সময় মুখোশের আড়ালে আসল মানুষটা বেরিয়ে আসে। স্বচ্ছভাবে তাকে দেখতে পাওয়া যায়। সমাজের বৈকল্য স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। অনেকে মেয়েদের ছবি বিকৃত করে। বিভিন্ন পর্নোসাইটে তার অনুমতি ছাড়া ছবি দিয়ে দেয়। এসব বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ। আবার কোনো মেয়েকে কেন্দ্র করে কিছু ঘটলে সব পুরুষ সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মানুষ হিসেবে তাকে দেখে না। এটা নারীকে পণ্য হিসেবে দেখার যে প্রবণতা, এটি তার আরেকটি বহিঃপ্রকাশ। ওয়েব প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মুক্ত বিচরণভূমি। ফলে যাঁরা শুদ্ধচিন্তা করেন এবং প্রগতিশীল, তাঁদের দায়িত্ব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠা। অনলাইনে তৈরি হওয়া এই সমাজকেও শুদ্ধ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে বিশিষ্টজনদের। তাঁদের ব্লগসাইটে অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই এই বিকৃত মানসিকতার লোকেরা অবদমিত হবে।
‘মুক্তচিন্তার প্রকাশের মাধ্যম হলেও অন্যকে হেয় করবে, এমন কোনো লেখা প্রকাশ করা যাবে না। কর্তৃপক্ষকে যথাযথ সঞ্চালক বা মডারেটরের মাধ্যমে এসব ব্লগ বিবেচনায় নিতে হবে। এ ছাড়া ফেসবুকে নিজের মডারেটর নিজেকেই হতে হবে। যাতে ওয়ালে কোনো আজেবাজে লেখা না থাকে। অন্যরা দেখতে না পায়। কারও এ ধরনের প্রবণতা থাকলে শুরুতে সতর্ক করে দিতে পারেন। তাতে কাজ না হলে বন্ধুতালিকা থেকে বাতিল করে দেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, শুধু ভার্চুয়াল জগতে নয়, বাস্তব জীবনেও এসব পুরুষের বিকৃত মানসিকতার শিকার হন নারীরা। নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ থাকবে। এটি খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে গেলে তা নারীর জন্য লাঞ্ছনার শামিল হয়। যেসব পুরুষ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে বা নিপীড়ক হিসেবে নারীকে হেনস্তা করে, তাদের কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন। তবে পরিবার থেকেই এর শুরু হতে হবে। এর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে। দেখতে হবে, এসব সামাজিক যোগাযোগের সাইটে কোন পর্যায়ে গেলে তা নারীর নির্যাতন হয়। যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে হবে, সে সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। অন্য কোনো নির্যাতন বা হুমকির সম্মুখীন হলে থানায় গিয়ে জিডি করা যায়। কিন্তু এসব মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হলে জিডি করার কোনো নিয়ম আছে কি না, তা জনগণকে জানাতে হবে। সাইবার ক্রাইম নিয়ে আইন থাকলেও সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তেমন সচেতনতা নেই। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, আইন হলেও এর যেন কোনো অপব্যবহার না হয়। নারীকে অপদস্থ করে তারা আনন্দ পায়। এটা কোনো কোনো পুরুষের নৈতিক অবক্ষয়ের আরেকটি প্রকাশ। মনে রাখতে হবে, এর মাধ্যমে কোনো কিছু অর্জন করা যায় না। তবে আইনের সঠিক ব্যবহার হলে শাস্তির ভয় থাকে।
পাইল্যাবস বাংলাদেশ লিমিটেডের মাহমুদুল হাসান বলেন, এই সমস্যা এক দিনে সমাধান করা যাবে না। মানুষের মানসিকতা, মূল্যবোধ ও আচার আচরণ সংযত করতে হবে। পরিবার থেকে যদি এসব শিখে আসে, তাহলে তার পক্ষে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। সেখানেই নারীকে সম্মান দিতে শেখাতে হবে।
অন্যকে শ্রদ্ধা করার বিষয়টি শেখানো যাবে না। এ নিয়ে ফেসবুক ব্লগে ইতিবাচক পোস্ট লিখতে হবে। এ ধরনের জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। এ ছাড়া অনলাইন মানববন্ধন করা যেতে পারে। এতে সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটবে।