মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১১

তিন বিঘা করিডোর

বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে গত কয়েক দশক ধরেই অন্যতম আলোচনা ও বিরোধের বিষয় হয়ে আছে রাষ্ট্রীয় ভৌগলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ভূখণ্ড। উভয় দেশেরই মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এসব জনপদের পরিচিতি ছিটমহল নামে।

আর এই ছিটমহল মানে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ভূখণ্ড। তবে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যেও আবার বাংলাদেশের ভূখণ্ড রয়েছে।

কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই রয়েছে চন্দ্রখানা নামে বাংলাদেশের এক ছিটমহল।

বস্তুত ভারত ভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালে প্রণিত এক ব্রিটিশ আইন এ ধরনের ছিটমহল জন্মের প্রেক্ষাপট রচনা করে।

ওই আইনে বলা হয়, উপমহাদেশের স্বাধীন অঞ্চলগুলো তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে অথবা চাইলে স্বাধীন সত্ত্বা নিয়েও থাকতে পারবে।

এ আইনের সুযোগ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দেয় রাঙামাটির রামগড় ও পূর্ব বান্দরবান। আর পূর্ব সীমান্তের পার্বত্য ত্রিপুরা ও উত্তরের কুচবিহার যোগ দেয় ভারতে।

কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় কুচবিহার নিয়ে।

জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ তখন কুচবিচারের রাজা। তার জামিদারি বিস্তৃত ছিলো বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কিছু অংশে।

অপরদিকে রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারের কিছু তালুক ছিল কুচবিহারের সীমানায়। ভারত ভাগের সময় এসব জমি নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হন তারা।

এ পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। স্বদেশি আইনজীবী সিরিল র‌্যাডক্লিফের নেতৃত্বে সীমানা নির্ধারণের কমিশন গঠন করে দেন তিনি।

এই দায়িত্ব নিয়ে ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারত আসেন র‌্যাডক্লিফ। মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তিনি।

এর তিন দিন পর ১৬ আগস্ট সীমানার মানচিত্র প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু তাড়াহুড়োর কাজে স্বভাবতই অনেক ভুল-ভ্রান্তি-অপূর্ণতা রয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি। যথার্থ হয়নি র‌্যাডক্লিফ কমিশনের সীমানা নির্ধারণ। উপরন্তু কমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থে দেশভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলে বলেও অভিযোগ ওঠে।

এসবের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে ভারতের ভেতরে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু ভূখণ্ড ও পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে ভারতের কিছু ভূখণ্ড রয়ে যায়। মূল রাষ্ট্রীয় সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন এসব ভূখণ্ডই পরবর্তীতে ছিটমহল নামে পরিচিতি পায়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ঝুলতে থাকা ছিটমহল সমস্যা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সমস্যায় পরিণত হয়।

বাংলাদেশ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের হিসাবে, উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম আর কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারী থানার কিছু জমি ভারতের সীমান্ত জেলা কুচবিহারের অধীনে রয়েছে।

অপরদিকে কুচবিহারের কিছু জমি বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বোদা ও দেবীগঞ্জ, নীলফামারীর ডিমলা, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম এবং কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় রয়েছে।

এসব নিয়ে ১৯৯৬ সালের ১ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর ও ভারতের বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক হয় কলকাতায়। ওই বৈঠকের সিন্ধান্ত অনুযায়ী ওই বছরই মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে তৈরি করা হয় ছিটমহলের তালিকা।

ওই তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মোট ১৬২ ছিটমহলের আয়তন দাঁড়ায় ২৪ হাজার ২৬৮ দশমিক ০৭ একর।

ওই তালিকা থেকে আরো জানা যায়, ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ছিটমহল রয়েছে ৫১টি। এগুলোর আয়তন ৭ হাজার ১১০ দশমিক ০২ একর। অপরদিকে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ০২ একর।

সাম্প্রতিক জনগণনা অনুযায়ী, ভারতী ছিটমহলের লোকসংখ্যা ৩৭ হাজার। আর বাংলাদেশের ছিটমহলে বাস করে ১৪ হাজার মানুষ।

ভারতীয় ছিটমহলগুলোর অধিকাংশই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এ সবের মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯, পঞ্চগড়ে ৩৬, কুড়িগ্রামে ১২ ও নীলফামারিতে চারটি ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে।

অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। এর মধ্যে ৪৭টি কুচবিহার ও চারটি জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত।

ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলবাসীর বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতীয় ছিটমহলবাসীর ভারতের নাগরিকত্ব থাকলেও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা। মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন দিনের পর দিন।

আইনি জটিলতায় কোন দেশের পুলিশই তৎপর হয় না এসব ভূখণ্ডে। তাই হরহামেশা এসব এলাকায় ভয়ংকর অপরাধীদের দাপট বাড়ে।

এছাড়া ব্যাংক, বিদ্যুৎ, পাকা সড়ক, সেতু, হাটবাজার আর বিদ্যালয়ের অভাবে যথাযথ বিকাশও হয় না এসব এলাকার মানুষের।

তারওপর ভারতের নাগরিক হয়ে ভারতে আর বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও বাংলাদেশে ইচ্ছেমতো যাওয়া-আসার অধিকার বঞ্চিত তারা। চিকিৎসা সেবাও নাজুক এখানে। নেই পর্যাপ্ত পানীয় জলও।

রাস্তা বলতে যেন জমির আইল আর সেতু বলতে বাঁশের সাঁকোকেই বোঝেন ‘ছিটের মানুষ’ হিসেবে উভয় দেশে নিগৃহীত ছিটমহলবাসী। ঠিক যেন ‘না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা তাদের।

এ অবস্থা থেকে ছিটমহলবাসীকে মুক্তি দিতে ছিটমহল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগও নেওয়া হয় বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু ভেস্তে যায় সব ক’টিই।

ছিটমহল সমস্যা সমাধানের সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৪৭ সালে। কিন্তু পাক-ভারত বৈরিতায় ভেস্তে যায় সেটা।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৫৮ সালে চুক্তির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। বেরুবাড়ী ছিটমহল হস্তান্তরের একটি যৌথ ঘোষণায়ও সই করেন তারা।

ওই চুক্তি অনুযায়ী, বেরুবাড়ীর উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা বাংলাদেশের পাওয়া কথা ছিলো।

পরবর্তীতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশে এ সম্ভাবনা আটকা পড়ে।

১৯৫৮ সালের চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের কথা উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি।

তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে।

পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে ছিটমহল বিনিময় দফায় দফায় বিলম্বিত হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ১৬ মে উভয় দেশের স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ বিষয়ক এক চুক্তিতে সই করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

ওই চুক্তিতে উভয় দেশের মধ্যে দ্রুত ছিটমহল বিনিময়ের তাগিদ দেওয়া হয়।

মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির নামে ওই চুক্তিতে আরো বলা হয়, দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ দিকের অর্ধাংশ ও পার্শ্ববর্তী ছিটমহলগুলো পাবে ভারত। বিনিময়ে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমলের অধিকারী হবে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশের পানবাড়ী মৌজার সঙ্গে দহগ্রামকে সংযুক্ত করতে বাংলাদেশকে ‘তিন বিঘা’ নামে ১৭৮ দশমিক ৮৫ মিটার এলাকা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেবে ভারত।

এ চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে বেরুবাড়ি দিয়ে দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত এ শর্ত বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকে।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশকে তিন বিঘা ব্যবহারের অনুমতি দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও এর মধ্যে আরো একটি চুক্তি হয়।

এ চুক্তির ভিত্তিতে ১৯৯২ সালের ২৬ জুন তিন বিঘা করিডর ব্যবহারের শর্তযুক্ত অনুমতি দেয় ভারত। এতে ছিটমহলের বাসিন্দাদের সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা পরপর ওই করিডোর দিয়ে চলাচলের সীমিত সুযোগ তৈরি হয়।

অনেক দেনদরবারের পর ২০০১ সালের ১১ মার্চ থেকে শুধু দিনের বেলা কোন বিরতি ছাড়াই ১২ ঘণ্টা তিনবিঘা করিডর দিয়ে চলাচলের অনুমতি মেলে।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ছিটমহল সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয় আওয়ামী লীগও। তবে কাজ হয়নি তাতেও।

দিল্লিতে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে দু’দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে যৌথ সীমানা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ পর্যন্ত গোটা চারেক বৈঠক করে ১৯৭৪ সালের চুক্তির আলোকে সীমান্ত সমস্যা সুরাহার সিদ্ধান্ত নেয় উভয় পক্ষ।

ছিটমহল ও অপদখলীয় জমিগুলোতে ২০০৭ সালে যৌথ সফরের পর ধাপে ধাপে বিষয়গুলো সুরাহার প্রস্তাব তোলে বাংলাদেশ।

কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, ধাপে ধাপে নয়, সমন্বিতভাবে বিষয়গুলো সমাধান করতে চায় তারা।

সর্বশেষ ভারতের মনমোহন সিংহ দু’দিনের বাংলাদেশ সফরে এসে ৬ সেপ্টেম্বর তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার ঘোষণা দেন।

কিন্তু এতেও সমাধান হয় না ছিটমহল সমস্যার। তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলার রাখার ঘোষণা দিলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর সব ছিটমহল নিয়ে কোন কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছতে ব্যর্থ হন।
তাই বাংলাদেশে মনমোহনের সফরের দ্বিতীয় ও শেষ দিন ৭ সেপ্টেম্বর থেকেই নতুন করে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ শুরু হয় ছিটমহলগুলোতে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের ছিটমহলের বাসিন্দারাই নানা কর্মসূচি পালন শুরু করেন। এমনকি টানা দু’রাত বাতি নিভিয়ে রেখে অভিনব প্রতিবাদ জানায় উভয় দেশের ‘ছিটের মানুষ’। সাড়ে ছ’ দশক অপেক্ষা করেও স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিকের জীবন-যাপনের স্বপ্ন যেন লুকোচুরি খেলছে তাদের সাথে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন