বৃহস্পতিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১১

ওজন



বাড়তি ওজন একজন মানুষের কত রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ও রোগ শোকের কারণ হতে পারে এ কথা আমরা সকলেই মোটামুটি জানি। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হূদরোগ, কিডনিরোগ, বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার ইত্যাদির অন্যতম কারণ হল মোটা হওয়া বা বাড়তি ওজন। কিন্তু আমরা জানি কি বাড়তি ওজন আমাদের সন্তান জন্মদানের সক্ষমতার উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে।

আমাদের মনে এরকম প্রশ্ন আসতেই পারে যে, অনেক মোটা মহিলাইতো সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। কিন্তু এটা সত্যি যে, যারা সন্তান জন্মদানে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন অথবা যেসব মেয়েদের মাসিক অনিয়মিত হয় তাদের মধ্যে বেশি ওজনের মেয়ে/মহিলাদের আধিক্য বেশি। অনেক গবেষণাতেই একথা প্রমাণিত হয়েছে বাড়তি ওজনের মেয়েদের মধ্যে অনিয়মিত ঋতুচক্র এবং ডিম্ব পরস্ফুিটনের হার কম হয়; যা সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এমনকি ‘পলিসিস্টিক ওভারী সিনড্রোম’ (মেয়েদের এক ধরণের রোগ) না থাকলেও শুধুমাত্র বেশি ওজনের কারণে ডিম্ব পরস্ফুিটন কম হতে পারে। এরপরও যদি একজন স্থূল মহিলা গর্ভধারণ করেন তাহলেও তার গর্ভকালীন সময়ে নানা রকম সমস্যা হতে পারে। গর্ভবতী মা’র উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, নিদ্রাহীনতা, প্রি-একল্যাম্পসিয়া, ক্ষত দেরীতে সুকানোসহ নানা রকম সমস্যার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া এসব ক্ষেত্রে সিজারিয়ান অপারেশন দ্বারা সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

ওজন বেশি থাকলে শরীরে হরমোন ও মেটাবলিক অনেক পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে ডিম্ব পরস্ফুিটনের সমস্যা ছাড়াও ব্রুন বেড়ে উঠায় অনেক সমস্যা হয়। এটি হয় বিভিন্ন সেক্স হরমোন নি:স্বরণ ও কার্যকারিতার পরিবর্তনের কারণে। এমনকি জরায়ুতে ব্রুন Implantation হতেও সমস্যা হয়। এছাড়াও মেয়েদের যেসব সমস্যার কারণে সন্তান হয়না তার মধ্যে একটা কারণ হল Gonadotrophin হরমোন ঠিকই নি:সৃত হচ্ছে কিন্তু ডিম্ব পরস্ফুিটন হচ্ছে না। এ অবস্থা তখনই সৃষ্টি হয় যখন ওজন বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে ডিম্ব পরস্ফুিটনের সময় ওভারিয়ান ফলিকলে যদি Human chorionic Gonadotrophin (HCG) নামক হরমোনের পরিমাণ কম থাকে তাহলে ডিম্ব নিষিক্ত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। স্থূলকায় মহিলাদের ওভারিয়ান ফলিকলে এই হরমোন অনেক কম থাকে এবং এদের ডিম্বের মান ও গর্ভধারণ হারও অনেক কম। এছাড়াও গর্ভধারণের সাথে ওজনের সম্পর্কটা স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায়, যেসব সুস্থ মহিলা টেস্টটিউব পদ্ধতিতে অন্যের ডিম্ব গ্রহণ করেছেন তাদের ক্ষেত্রেও গর্ভধারণের হার অনেক কম। টেস্টটিউব পদ্ধতিতে যে ওষুধগুলো ব্যবহূত হয় তা অত্যন্ত উচ্চমূল্যের। আর যাদের ওজন বেশি তাদের জন্য ওষুধও লাগে বেশি পরিমাণে। শুধু তাই নয়, তাদের ক্ষেত্রে বেশি হেজঐ agoinsl ব্যবহার করে তুলনামূলকভাবে কম ডিম্ব পাওয়া যায়। জেনে রাখা ভালো, টেস্টটিউব পদ্ধতিতে অনেকগুলো ডিম্বের প্রয়োজন হয়। সুতরাং; দেখা যাচ্ছে যে, টেস্টটিউব পদ্ধতিতেও সাফল্যের হার অনেকাংশেই নির্ভর করে নারীর ওজনের উপর। তারপর দেখা গেলো এসব স্থূল মহিলাদের ক্ষেত্রে ভ্রুন তৈরী হয়েছে ঠিকই কিন্তু এদের বিভিন্ন সমস্যা লেগেই থাকে। যেমন- স্থূল মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ুতে ভ্রুনের Implantation কম হয়। প্রথম ৬ সপ্তাহে অ্যাবরশনের হারও বেশি হয় এবং তাদের জীবিত সন্তান জন্মদানের হারও কম। এছাড়াও স্থূল মহিলাদের ক্ষেত্রে টেস্টটিউব পদ্ধতিতে বিভিন্ন সমস্যা উদ্ভব হওয়ার কারণে যে চিকিত্সা চলে তা প্রায়শ; বাতিল করে দিতে হয়। এতে রোগীরা যেমন আর্থিক ক্ষতির সমুক্ষীন হয় তেমনি মানসিকভাবেও বিপর্যস্থ হয়ে থাকেন। এত কিছুর পরও কোন স্থূল মহিলা গর্ভধারণ করতে সক্ষম হলেও সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেই মিসক্যারেজ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

ওজন কমাতে পারলে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে যে পজিটিভ ফলাফল পাওয়া যায় তা অনেক গবেষণাতেই প্রমাণিত হয়েছে। যেমন- একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১০ কেজি ওজন কমানোর ফলে যাদের ডিম্ব পরস্ফুিটন হতো না তাদের মধ্যে ৮৯.৬%-এ আবার নিয়মিতভাবে ডিম্ব পরস্ফুিটন হচ্ছে ৭৭.৬% এর ক্ষেত্রে গর্ভসঞ্চার হয়েছে ৬৭% এর ক্ষেত্রে সুস্থ সন্তান জন্মলাভ হয়েছে। মিসক্যারেজ এর হার পূর্বের ৭৫% থেকে কমে ১৮% এবং প্রতি বাচ্চার জন্য খরচ পূর্বের তুলনায় ৫৫% কম হয়েছে। উক্ত গবেষণাটি করা হয়েছিল বেশি ওজনের নি:সন্তান নারীদের নিয়ে।

শুধু বেশি ওজন নয়, আদর্শ ওজনের চেয়ে কম ওজন থাকলেও (বিএমআই>১৮.৫) সমস্যা হয়। এদের ক্ষেত্রেও ওভোলেসন কম হয়, জরায়ুতে ভ্রুনের Implantation কম হয় এবং গর্ভসঞ্চারের হারও কম হয়। উভয় ক্ষেত্রে সমস্যার ধরণ এক হলেও বেশি ওজন হলে সমস্যাগুলো প্রকট হয়। তাই বেশি ওজন নিয়ে এত বেশি কথা এবং এত গবেষণা।

সুতরাং যারা স্বাভাবিক বা টেস্টটিউব পদ্ধতিতে সন্তান নিতে ইচ্ছুক তাদের জন্য পরামর্শ হল আপনার বাড়তি ওজন কমিয়ে আদর্শ সীমার মধ্যে নিয়ে আসুন- তাহলে আপনার সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে এমনিতেই। এমনকি টেস্টটিউব পদ্ধতিতেও সাফল্যের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, নিয়মিত ব্যায়াম, জীবন যাত্রার ধরণ পরিবর্তন, সর্বোপরি আপনার একান্ত ইচ্ছাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়তি ওজন কমাতে সাহায্য করে। তারপরও ওজন কমাতে ব্যর্থ হলে অভিজ্ঞ কারও পরামর্শ নিতে পারেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন