মানব সভ্যতার ইতিহাসে গ্রিক সভ্যতা এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। বিশ্ব জগৎ যখন সভ্যতার দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল, গ্রিক জাতি তখন জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে চারদিক আলোকিত করছিল। শুধু পেরিকেলস যুগে গ্রিসের এথেন্সে যেসব পণ্ডিত ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল বিশ্বের অন্য কোথাও একসঙ্গে একই সময় এত পণ্ডিত ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেনি। ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ভাস্কর্য, শিল্পকলা, ধর্ম, গণিত, ইতিহাস, স্থাপত্যশিল্প, চিকিৎসা বিজ্ঞান-প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাদের অবদান বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয়। গ্রিক পণ্ডিতদের জ্ঞানের প্রভাব সবসময় সারা বিশ্বের সব দেশ ও জাতির ওপর বিদ্যমান থাকবে। প্রাথমিক যুগে গ্রিকরা নিজেদের 'গ্রিস' বা হেল্লাস' নামে অভিহিত করত। এই গ্রিস থেকেই পরবর্তীতে ২৫ হাজার বর্গমাইল বিশিষ্ট এ দেশটির নামকরণ করা হয় গ্রিস। দেশটি ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। গ্রিকরা হেলেন নামক এক পূর্ব-পুরুষের বংশধর বলে নিজেদের হেলেনিজ এবং নিজেদের দেশকে হেল্লাস বলে ডাকত। কিন্তু পরবর্তীকালে রোমানরা তাদের দেশকে গ্রিস ও গ্রিক নামে অভিহিত করে। প্রাচীনকালে গ্রিস একটি দেশ হলেও এক রাষ্ট্র ছিল না। সে সময় সেখানে অজস্র স্বাধীন নগর রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। গ্রিসের ইতিহাস মানেই পৃথক পৃথকভাবে এ নগর রাষ্ট্রগুলো। প্রাচীন গ্রিসের এসব নগর রাষ্ট্রের মধ্যে এথেন্স, স্পার্টা, করিন্থ, থিবেস, ম্যাডিসন, আরগস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি নগর রাষ্ট্র নিজস্ব নিরাপত্তা প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। নগর রাষ্ট্রগুলোর ছিল নিজস্ব সরকার, নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যবোধ, নিজস্ব ধর্ম, নিজস্ব দেবদেবী ও নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব। নগর রাষ্ট্রগুলো ছিল আয়তনে ছোট অর্থাৎ প্রায় ১০০ বর্গমাইল এবং এগুলোর জনসংখ্যাও ছিল সীমিত। নগর রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কলহে লিপ্ত থাকত। কিন্তু যতই অন্তর্কোন্দল থাক না কেন বিদেশি শক্তিকে প্রতিরোধ করতে গ্রিকবাসী সবসময় একতাবদ্ধ থাকত। নগর রাষ্ট্রগুলোতে গ্রিকরা সুন্দর সুন্দর মন্দির নির্মাণ করতে পছন্দ করত। প্রায় প্রতিটি নগর রাষ্ট্রেই প্রথমদিকে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল; কিন্তু পরবর্তীতে চতুর্থ ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিসের সব নগর রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রিক সভ্যতার পতনের মূলে বেশকিছু কারণও ছিল। স্বৈরাচারী ও গণতান্ত্রিক মতবাদ নিয়ে গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিবাদ-সংঘর্ষ প্রায় লেগেই থাকত। যার ফলে নগর রাষ্ট্রগুলো পতনের পথে ধাবিত হতে শুরু করে। এ পতনের আরেকটি কারণ হলো তাদের নিজস্ব অনৈক্য ও দুর্বলতা। রোম সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের সময় নগর রাষ্ট্রগুলোর কলহ-বিবাদ আরও প্রকট রূপ ধারণ করে। যার ফলে রোমানরা গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলো অধিকার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। তাদের পতনের আরেকটি কারণ হলো পারস্য ও মেসিডোনিয়ার গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোতে আক্রমণ করা। এরপর আলেকজান্ডারের আবির্ভাবের ফলে গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর কবর রচিত হয়। কিন্তু সে সময় আলেকজান্ডারের বিশ্বের সভ্য দেশগুলো অধিকার ও দখল করার ফলে বিশ্ব ইতিহাসে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়, গঠিত হয় পশ্চিম আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত। কিন্তু এত কিছুর পরও নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিতে হয় যে, আজও প্রায় সবদিক থেকেই বিশ্ব সভ্যতা গ্রিকদের কাছে চিরঋণী। বিশ্বের প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই গ্রিকরা তাদের কৃতিত্ব সংযোজন করে গেছে। বিখ্যাত বীর আলেকজান্ডার, দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টেটল, প্লেটো, প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ হেরডেটাস, বিজ্ঞানী পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড হিপোক্রেটস, এপেলেসের মতো গ্রিসের আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এখনো বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন